বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে দলবদল, দলে নতুন মুখের যোগদান অব্যাহত। এবার সেই তালিকায় নাম উঠল বিখ্যাত অভিনেতা দীপঙ্কর দে–র। শুক্রবার তিনি যোগ দিলেন তৃণমূলে। তাঁর হাতে দলের পতাকা তুলে দেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা ব্রাত্য বসু। তিনি ছাড়াও এদিন তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন অভিনেতা ভরত কল, লাভলি মৈত্র, মার্গ সঙ্গীতশিল্পী রশিদ খানের মেয়ে শাওনাও।
তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর দীপঙ্করবাবু রাজনীতিতে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যে মন্তব্য করে বসেন, তা নিয়ে রাজনীতিতে জল্পনা তৈরি হয়েছে। আর সেই জল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছে তৃণমূল। এদিন ব্রাত্য বসুর হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা নেওয়ার পর দীপঙ্কর দে বলেন, ‘তৃণমূলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আজকের নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এই যোগাযোগ রয়েছে। আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে দেখতে অরূপ বিশ্বাসকে পাঠিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, দু’বার আমার হাসপাতালের বিলও মিটিয়েছে রাজ্য সরকার।’ পাশাপাশি তিনি এ কথাও বলেন, ‘রাজ্য সরকার আমাকে বঙ্গভূষণ ও বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার দিয়েছে।’ এর পরই তিনি মন্তব্য করে বসেন, ‘আমি বেইমান নই। যাঁর নুন খেয়েছি, তাঁর সঙ্গে বেইমানি করতে পারব না।’
আর ঠিক এই জায়গাতেই একটা বিতর্ক তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যা নিয়ে বাংলার রাজনৈতিক মহলে ইতিমধ্যে জল্পনা তৈরি হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনেকেই বলতে শুরু করে দিয়েছেন, এর অর্থ কি এই যে, রাজ্য সরকার যখনই কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিভিন্ন কারণে সহায়তা করে, বা সম্মান দেয়, তা কি শর্তাধীন? তার পেছনে কি কোনও শর্ত থাকে? সেই শর্ত কি রাজ্যের শাসক দলে যোগ দেওয়া? সরাসরি বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া না জানালেও কিছুটা অস্বস্তি যে দলের মধ্যে হয়েছে, তা গোপন থাকেনি। সূত্রের খবর, ঘনিষ্ঠ মহলে অনেক নেতাই ব্যাখ্যা দিয়েছেন, আসলে দীপঙ্কর দে তো কখনও রাজনীতি করেননি, তাই মেপে রাজনৈতিক মন্তব্য করতে পারেন না।
যদিও এদিন সহ–অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের বিজেপিতে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে তীব্র শ্লেষ ঝড়ে পড়ে দীপঙ্কর দে–র মুখে। তিনি বলেন, ‘যাঁর যেখানে পাঁপড় বেলতে ভালো লাগে, তা তাঁরা বেলুন। এতে আমার কী বলার আছে?’ পাক্কা রাজনৈতিক নেতার মতোই শুনিয়েছে দীপঙ্কর দে–র এ কথা। অবশ্য দীপঙ্কর দে–র এই শ্লেষের জবাবে এদিন রাত পর্যন্ত মুখ খোলেননি রুদ্রনীল। এদিকে, এদিনই একই মঞ্চে বাম মনোভাবাপন্ন অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ এবং রাজনৈতিক নেতা মদন মিত্রের উপস্থিতি থাকা নিয়ে নতুন একটি জল্পনা তৈরি হয়েছে। নারী শক্তির বহিঃপ্রকাশের জন্য ‘শক্তিরূপেণ’ নামে একটি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন তাঁরা। সেখানে সায়নীর প্রশংসা করে মদন মিত্র বলেন, ‘সায়নী তো বটেই, কারও গায়ে একটুও যদি আঁচ লাগে, তা বরদাস্ত করা হবে না। গোটা বাংলায় আগুন জ্বলবে।’
জবাবে নেতার পাল্টা প্রশংসা করে সায়নীও বলেন, ‘মদনদা বাংলার ক্রাশও। সংস্কৃতি জগতের বহু মানুষই তাঁকে পছন্দ করেন।’ এর পরই তিনি রাজ্য সরকারের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘নারী সুরক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ এক নম্বর। একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।’ এর পরই রাজ্যের বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এবার কি তা হলে সায়নী তৃণমূলের দিকেই পা বাড়াচ্ছেন? কিন্তু, কথা হল, সংস্কৃতি মহলে তিনি এতদিন বাম মনোভাবাপন্ন বলেই পরিচিত ছিলেন। এমনকী, বামপন্থী পরিচালক অনীক দত্তের ‘ভবিষ্যতের ভূত’ সিনেমা নন্দনে মুক্তির অনুমতি না পাওয়া নিয়ে তিনি প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রবীন্দ্র সদন, নন্দন চত্বর–অন্য হলগুলিতে ‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী অনুপ্রেরণা’ লেখা এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে ছয়লাপ থাকা নিয়ে অনীক বক্রোক্তি করেছিলেন। অভিযোগ ওঠে, সেইজন্যই তাঁর ওই সিনেমা নন্দনে মুক্তি পায়নি। তখন সায়নীর প্রতিবাদ বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছিল।
কিন্তু তিনি এখন যে ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্য সরকারের প্রশংসা করছেন, তাতে অনেকেরই ধারণা, তিনি হয়তো তৃণমূলে যোগ দিতে চলেছেন। উল্লেখ্য, হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় বিজেপি এবং কিছু মানুষের সমালোচনার মুখে পড়েন সায়নী। তার পরই মুখ্যমন্ত্রী এক জনসভায় সায়নীর পাশে আছেন বলে বার্তা দেন। তখন থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা শোনা যাচ্ছে সায়নীর মুখে। আর এদিন এক মঞ্চে মদন মিত্রের সঙ্গে তাঁর উপস্থিত থাকা নিয়ে সেই জল্পনা অন্য মাত্রা পেয়ে গিয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগে তৃণমূলে যোগ দেন সৌরভ দাস ও কৌশানি মুখোপাধ্যায়। অন্যদিকে, সংস্কৃতি জগতের আর এক দিকপাল ফ্যাশন ডিজাইনার তথা বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল ফের রাজ্য সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন। এদিন তিনি জোড়াবাগান–কাণ্ডের প্রতিবাদে সরব হন।
দলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে তিনি জোড়াবাগান থানায় গিয়ে জোড়াবাগানের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও অভিযুক্তের কঠোরতম শাস্তির দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘রাজ্যে একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও একের পর এক এই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে রাজ্য সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। আর সরকারের নির্দেশে পুলিশও নিষ্ক্রিয়।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘একটি বাচ্চা মেয়ের ওপর যৌন নির্যাতন করে খুন করার পরও কেন একটিও কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না মুখ্যমন্ত্রী?’ প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার জোড়াবাগানের বৈষ্ণব শেখ স্ট্রিটের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় বছর নয়ের এক শিশুর মৃতদেহ। তাঁকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।